মুক্তিযুদ্ধ আমাদের যে মর্যাদা,আত্মবিশ্বাস, অহঙ্কার, সততার শিক্ষা, মাথা উঁচু করে চলার উজ্জীবনী শক্তি, ন্যায় বলার, প্রতিবাদী হওয়ার, দেশের জন্য কিছু করে যাওয়ার অধিকার দিয়েছেÑ তা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জাগ্রত করা দরকার। নবীন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা,দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতাকে তুলে ধরে এর চেতনাকে তাদের হৃদয়ে ধারণ করানোর এখনই সময়। মহান মুক্তিযুদ্ধ একটা ঘটনা মাত্র নয়, এর রয়েছে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা। এ দেশের মুক্তিকামী জনতা একটি ফুলকে বাঁচাতে, একটি পতাকা ওড়াতে জীবনকে তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা ও মুক্তির লড়াইয়ে।
বিজয় দিবস। খুব কম জাতির ইতিহাসে এরকম একটি স্বর্ণালি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের দেখা পাওয়া যায় যেখানে এক দিকে আনন্দ-উচ্ছল উদ্বেলিত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নিল দ্যুতি,অপর দিকে দুঃখ বেদনা, স্বজন হারানোর দুঃসহ নীল অনুভূতি। এ জন্য বিজয় দিবসের আবহ এলেই পরিবর্তিত হয়ে যায় গোটা জাতির মানস। এক দিকে পাওয়ার আনন্দের উচ্ছলতা,অপর দিকে বিয়োগ-বেদনার অসহনীয় স্মৃতির ক্যানভাস ডানা মেলে। প্রাপ্তি ও হারানোর মহামিলনের দিন বিজয় দিবস। এই দিনের স্বপ্নে যারা শহীদ হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, যারা এখনো বেঁচে আছেন তারা ইতিহাস তৈরি করতে গিয়ে নিজেরাই একেকটি ইতিহাস হয়ে গেছেন।
বিজয়ের দিন এলেই কেমন একটা আনন্দের সুবাতাস, সাথে সাথে অসহনীয় দুঃখ বেদনার যন্ত্রণার নীলে জাতি নতুন করে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষতে বসে। যে স্বপ্নের চেতনায় দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা, অনেকসময় প্রকৃত পক্ষেই খালি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একটি অসম যুদ্ধে, তাদের স্বপ্নের কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, কতটুকু মর্যাদায় তাদেরকে অভিষিক্ত করা হয়েছে, তাদের স্বপ্নের গাংচিলেরা কোথাও ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে কি না- সব কিছুর একটি নস্টালজিক ভাবনা পেয়ে বসে এ দিনটির পদধ্বনি শোনা গেলেই। বিজয়ের প্রাক্কালে যে শিশুর জন্ম হয়েছিল আজ সে একান্ন বছরের পৌরুষে অভিষিক্ত। স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসের আবহে, দেশপ্রেমের চেতনায়, দেশ গড়ার প্রত্যয়ে নিবেদিত মনোভাব নিয়ে সে এতদূর এসেছে কি না, না হলে কেন হয়নি, এগুলো পর্যালোচনা করা এখন যৌক্তিক বিষয়। সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তার যে স্বপ্ন মুক্তিযুদ্ধকে শাণিত করেছিল, সামাজিক নিরাপত্তার বাতাবরণের আকাঙ্খা উচ্চকিত করেছিল গোটা জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায়, তারই বা কী অবস্থা? নতুন প্রজন্মের জন্য আগামী দিনগুলোতে কেমন আর্থসামাজিক ভবিষ্যৎ তৈরি হয়েছে সব কিছুই নতুন করে ভাববার দাবি রাখে।
৫১ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই অর্জিত ঈর্ষণীয় সফলতাগুলোকে কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। যোগাযোগ, কৃষি ও শিল্পে যে বিশাল অগ্রগতি এটি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। অস্বীকার করার উপায় নেই গড় আয়ু বৃদ্ধির কথা। খাদ্য উৎপাদনও ঈর্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। না খেয়ে মৃত্যুর খবর এখন আর শোনা যায় না। আন্তর্জাতিক আঙিনায় বাংলাদেশ বেশ শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থায় সদস্য পদে এখন বাংলাদেশ। শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। কমেছে প্রসবকালীন মাতৃ মৃত্যুহার। সুপেয় পানির সরবরাহ বেড়েছে। বেড়েছে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের চিত্র। রফতানি খাতেও প্রবহমান অগ্রগতির চিত্র।
বিপরীতে বিজয়ের হাসি ম্লান হয়ে যায় যখন দেখা যায়, গ্রাম-গ্রামান্তরের লেখাপড়া না জানা প্রবাসী শ্রমিকের অমানবিক শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত অর্থ একশ্রেণীর শিক্ষিত ও সমাজের উঁচু তলার সুবিধাভোগীরা অবলীলায় বিদেশে পাচার করেন। অশিক্ষিতরা পরিশ্রম করে দেশের জন্য যা অর্জন করেন, শিক্ষিত সুবিধাভোগীরা তা পাচার করে। বিজয়ের আনন্দ বিষাদের কালিমায় ঢেকে যায়, বায়ুদূষণে আমরা পৃথিবীর প্রথম না হলেও দ্বিতীয় অবস্থানে আছি জানলে, যেকোনো দিন প্রথম হওয়ার তকমা আমাদের ললাটে ঝকমক করে ওঠার শঙ্কায়। আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠছে শ্বাসযন্ত্রের নানাবিধ জটিলতা নিয়ে। ভেজালের কারণে অকালেই কিডনি, যকৃৎ ও অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত জনজীবন। হারিয়ে ফেলছে জীবনীশক্তি,ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক ভিত্তি। ভেজাল ওষুধ, ভেজাল খাবার, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও বিষাক্ত পরিবেশ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিষিয়ে তুলছে। রাস্তায়, বাজারে পথশিশুরা যখন করুণ চাহনি নিয়ে হাত পাতে তখন কিছু করতে না পারার যন্ত্রণায় হৃদয় ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। বিজয়ের আনন্দ ফ্যাকাশে হয়ে যায়, যখন দেখি মধ্যবিত্ত ক্রমেই তলানিতে যাচ্ছে। সমস্ত দ্বিধা সঙ্কোচ ও আত্মমর্যাদাকে বিসর্জন দিয়ে ওএমএসের চাল ডাল তেলের জন্য অসহনীয় প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকেন। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর প্রতীক্ষার এই সারি। বিজাতীয় সংস্কৃতির আলখেল্লা গোটা জাতিকে গ্রাস করছে দেখেও নির্বাক দর্শক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। নীতি, নৈতিকতা, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা দেখে মাথা ঠুকে মরতে ইচ্ছে করে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয় এটি দেখে যে, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পরিবর্তে পৈশাচিক উল্লাসে নির্মমভাবে হত্যা করছে নিজ সহপাঠীকে। চরিত্র, মেধা, মনুষ্যত্ব সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীরা হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। এ যেন ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ বিজয়োল্লাসের পরিবর্তে বিষাদের কালোমেঘ চিন্তার আকাশ ঢেকে দেয়- যখন দেখা যায় নৈতিকতা, চারিত্রিক গুণাবলি, মনুষ্যত্ব, সততা এগুলোকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও অভিন্ন জাতিসত্তার বিকাশের পরিবর্তে বিভাজিত জাতিসত্তা দেখে শঙ্কিত হতে হয়।
এসব সত্বেও আমাদের নতুন প্রজন্মের কিছু তথ্য জানা দরকার, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান সামরিকবাহিনীতে বিদ্রোহ করা প্রায় ২৬ হাজার সুপ্রশিক্ষিত সদস্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর সাথে যুক্ত হয় হাজার হাজার মানুষ। তাদের কারো ছিল কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ,আবার অনেকের কোনো প্রশিক্ষণ ছিলোই না। তবে তাদের সবার মনোবল ছিল দৃঢ়। লক্ষ্য ছিলো দেশকে শত্রুমুক্ত করা, দেশকে স্বাধীন করা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সমগ্র বাংলাদেশকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে চারজন অধিনায়ককে দায়িত্ব দেয়া হয়। এ গুলো ছিল চট্টগ্রাম, কুমিল্লা,সিলেট এবং দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল। পরবর্তীতে মুজিব নগর সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে ১০-১৭ জুলাই ১৯৭১ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে যুদ্ধ অঞ্চলের অধিনায়কদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনেই যুদ্ধের কৌশলগত সুবিধার জন্য সমগ্র দেশকে এগারোটি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এক নম্বর সেক্টর ছিলো চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম,নোয়াখালীসহ ফেনীর মুহুরী নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত। এই সেক্টরের পাঁচটি সাব সেক্টর ছিলো। নিয়মিত সৈন্য ছিলো ২ হাজার ১ শত এবং গেরিলা ছিলো ২০ হাজার। দুই নম্বর সেক্টর ছিলো কুমিল্লা জেলার কিছু অংশ, ঢাকা জেলার কিছু অংশ এবং ফরিদপুর জেলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। এ সেক্টরের ছয়টি সাব সেক্টর ছিলো। নিয়মিত সৈন্য ছিলো ৪ হাজার এবং গেরিলা ছিলো ৩০ হাজার। তিন নম্বর সেক্টর ঢাকা,কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও সিলেট জেলার কিছু কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। এ সেক্টরের নিয়মিত সৈন্য ছিলো ৬ হাজার ৬৯৩ এবং গেরিলা ছিলো ২৫ হাজার। এখানে সাব সেক্টর ছিলো সাতটি। চার নম্বর সেক্টর ছিলো সিলেট জেলার অংশ নিয়ে। এখানে নিয়মিত সৈন্য ছিলো ৯৭৫ জন আর গেরিলা ছিলো ৯ হাজার। এখানে সাব সেক্টর ছিলো ছয়টি । পাঁচ নম্বর সেক্টর ছিলো সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। এখানে সাব সেক্টর ছিলো ছয়টি, আর নিয়মিত সৈন্য ছিলো ১ হাজার ৯৩৬ জন। গেরিলা ছিলো ৯ হাজার। ছয় নম্বর সেক্টর দিনাজপুর ও রংপুর জেলার অংশ নিয়ে গঠিত। এখানে পাঁচটি সাব সেক্টর ছিলো। নিয়মিত সৈন্য ছিলো ২ হাজার ৩১০ জন এবং গেরিলা ছিলো ১১ হাজার। সাত নম্বর সেক্টর রংপুর,রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর জেলার কিছু কিছু অংশ ও পাবনা জেলা নিয়ে গঠিত। এখানে সাব সেক্টর ছিলো নয়টি। নিয়মিত সৈন্য ছিলো ২ হাজার ৩১০ জন এবং গেরিলা ছিলো সাড়ে বার হাজার। আট নম্বর সেক্টর যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা ও বরিশাল জেলার অংশ নিয়ে গঠিত। এখানে সাব সেক্টর ছিলো সাতটি। নিয়মিত সৈন্য ছিলো ৩ হাজার ৩১১ জন এবং গেরিলা ছিলো ৮ হাজার। নয় নম্বর সেক্টর ছিলো বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, ও ফরিদপুর জেলার অংশ নিয়ে গঠিত। এখানে সাব সেক্টর ছিলো তিনটি। নিয়মিত সৈন্য ছিলো ৩ হাজার ৩১১ জন এবং গেরিলা ছিলো আট হাজার। দশ নম্বর সেক্টর ছিলো নৌ-কমান্ডোদের নিয়ে। নৌ-কমান্ডোদের সংখ্যা ছিলো ৫১৫ জন। বিভিন্ন নদী বন্দর ও শত্রু পক্ষের নৌ-যানগুলোতে অভিযানের জন্য তাদের বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হতো। আর এগারো নম্বর সেক্টর ছিলো ময়মনসিংহ, সিলেট ও রংপুর জেলার অংশ নিয়ে গঠিত। এখানে সাব সেক্টর ছিলো সাতটি। নিয়মিত সৈন্য ছিলো ২ হাজার ৩১০ এবং গেরিলা ছিলো ২৫ হাজার। এসব সেক্টরের কমান্ডাররা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। উল্লেখ্য কম- বেশি ৩৫ জন অফিসার ও ক্যাডেট এবং ৫ শত বিমান সেনা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তি যুদ্ধে অংশ নেয়।
জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ‘‘ হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’’ বইয়ে লিখেছেন ‘‘—- পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য ৭ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজীকে ডেকে পাঠান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা.এম এ মালেক।—- গভর্নর বলতে শুরু করলেন যুদ্ধে যে-কোনো কিছুই ঘটতে পারে — তখন এক পক্ষ জেতে অন্য পক্ষ হারে। ——– এ সময় জেনারেল নিয়াজী তার দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছিলেন। সে-সময় একজন পরিচারক চা নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলে তাকে দ্রুত বের করে দেয়া হয়। সে পরে বাইরে গিয়ে বলে ভেতরে সাহেবরা কান্নাকাটি করছে। খবরটি দ্রুত ঢাকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।”
অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ‘৭১ দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বিকাল ৪ টা ৩১ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য বিনা শর্তে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে। আত্মসমর্পণের দলিলে পাকবাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী এবং সম্মিলিত বাহিনীর পক্ষে লেঃ জেনারেল জগজিত সিং অরোরা স্বাক্ষর করেন। সেই সাথে পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে ২৪ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল রক্তের বিনিময়ে আসে আমাদের অনেক ত্যাগের কাঙ্খিত স্বাধীনতা।
(লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক,কলামিস্ট ও সভাপতি,ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
Leave a Reply